দেশের চারশ’ কোটি ডলারের শিপিং বাণিজ্যের বড় একটি অংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন (বিএসসি)। বর্তমানে এই ৪০০ কোটি ডলারের ৯৫ শতাংশই নিয়ে যাচ্ছে বিদেশি জাহাজ মালিকেরা। তবে বিশাল অংকের এই বাণিজ্য নিজেদের কব্জায় আনতে এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বিএসসি। আগামী ২৩ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থাটি নিজেদের বহরে ৩২টি মাদার ভ্যাসেল যোগ করতে চাচ্ছে। বর্তমানে ৩০ বছরের পুরোনো ট্যাংকার ‘এমটি বাংলার সৌরভ’ ও ‘বাংলার জ্যোতি’ এবং সমপ্রতি চীন থেকে আনা নতুন বাল্ক ক্যারিয়ার ‘এমভি বাংলার জয়যাত্রা’ ও ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ রয়েছে বিএসসির বহরে। গতকাল বিএসসির সম্মেলন কক্ষে আসন্ন ৪১তম বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) উপলক্ষে সাংবাদিকদের সাথে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর ইয়াহ্ইয়া সৈয়দ উপরোক্ত আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বিএসসি অনেক পিছিয়ে গেছে। এটিকে এগিয়ে নেয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দেশে আমদানি-রফতানি পণ্য পরিবহনে সমুদ্রগামী জাহাজের ভাড়া বাবদ বার্ষিক খরচ হয় ৪০০ কোটি ডলার। এরমধ্যে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এবং দেশীয় অপরাপর জাহাজ মালিকেরা মাত্র ২০ কোটি ডলারের ব্যবসা করতে পারছে। বাকিটা নিয়ে যাচ্ছে বিদেশি জাহাজ মালিকরা।
রাষ্টায়ত্ত্ব সংস্থা বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কমডোর ইয়াহ্ইয়া সৈয়দ বলেন, এই সংস্থার বহরে বর্তমানে অন্তত ৪০-৫০টি মাদার ভ্যাসেল থাকার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। প্রকট অর্থাভাবের কথা উল্লেখ করে বিএসসির এমডি বলেন, গত ২৭ বছরে এই সংস্থার বহরে কোনো জাহাজ সংযোজিত হয়নি। সর্বশেষ ১৯৯১ সালে ‘এমভি বাংলার শিখা’ নামের জাহাজটি কেনা হয়েছিল। বিএসসির দুর্দিন ঘুচানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে চীন থেকে ছয়টি নতুন জাহাজ কেনা হয়েছে। এর দুইটি জাহাজ সংস্থার বহরে চলছে। অপর চারটি জাহাজও ক্রমান্বয়ে দেশে এসে পৌঁছবে।
বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনকে সরকারের উন্নয়ন সহযোগী এবং ব্লু-ইকোনমি ধারণা বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার বলে উল্লেখ করে কমডোর ইয়াহ্ইয়া সৈয়দ বলেন, রূপকল্প-২০২১ এবং ২০৪১ এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশ্ব মানের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শিপিং সংস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী ২৩ বছরে ৩২ টি জাহাজের সমন্বয়ে একটি সমৃদ্ধ বহর গড়ে তোলা হবে। তিনি বলেন, রামপাল, পায়রা ও মাতারবাড়ীতে তিনটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিদেশ থেকে লাখ লাখ টন কয়লা আমদানি করতে হবে। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার স্বার্থে কয়লার যোগান নিরবচ্ছিন্ন করতে ৮০ হাজার টনের ২টি মাদার বাল্ক ক্যারিয়ার এবং মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারিংয়ের জন্য ১০টি ১০ থেকে ১৫ হাজার টন ক্ষমতার বাল্ক ক্যারিয়ার কেনার প্রকল্প গ্রহন করা হয়েছে।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে ইস্টার্ণ রিফাইনারীর ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা দ্বিগুণ হবে। সব ক্রুড অয়েল বিএসসির নিজস্ব জাহাজের মাধ্যমে পরিবহনের জন্য ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার টন ক্ষমতার ২টি নতুন মাদার ট্যাংকার কেনা হবে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি বছর ৩০ লাখ মেট্রিকটন ডিজেল অয়েল এবং সাড়ে ৩ লাখ টন জেট ফুয়েল আমদানি করে। ইস্টার্ন রিফাইনারির বাস্তবায়নাধীন ২টি সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আমদানি করা ডিজেল ও জেট ফুয়েল পরিবহনের লক্ষ্যে ৮০ হাজার টন ক্ষমতার মাদার প্রোডাক্ট অয়েল ট্যাংকার কেনা হবে।
দেশের গ্যাস সংকট নিরসনের জন্য সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে। কঙবাজারের মাতারবাড়ীতে এফএসআরইউ টার্মিনাল স্থাপন করা হয়েছে, যা দেশের জাতীয় গ্যাস গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত। এলএনজি আমদানির জন্য বিএসসির ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার ধারণ ক্ষমতার ২টি, ১ লাখ ৭৪ হাজার ঘনমিটারের ২টি, ১ লাখ ৮০ হাজার ঘনমিটারের ২টি এলএনজি ভ্যাসেল যুক্ত করতে ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
‘বাংলার সৌরভ’ ও ‘বাংলার জ্যোতি’ দুটির জায়গায় ৩০-৩৫ হাজার টন ক্ষমতার নতুন ক্রুড অয়েল ট্যাংকার কেনা হবে বলেও উল্লেখ করেন বিএসসির এমডি কমডোর ইয়াহ্ইয়া সৈয়দ।
শ্রীলঙ্কাসহ বিমসটেক দেশগুলোর মধ্যে ফিডার সার্ভিস চালুর লক্ষে চারটি ১২শ থেকে দেড় হাজার টিইইউ’স ধারণ ক্ষমতার সেলুলার কন্টেনার জাহাজ কেনারও প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলে মতবিনিময় সভায় জানিয়েছেন বিএসসির এমডি।
তিনি বলেন, আরপিও’র মাধ্যমে শেয়ার বাজার থেকে নেয়া ৩১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকার মধ্যে এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৭৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকায় ২৫ তলা ভবন নির্মাণে ৫৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, শেয়ার বাজারজাতকরণে ১৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, চীন থেকে ৬টি জাহাজ কেনা খাতে ৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিএসসি ১২৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা আয় ও ১১৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। মুনাফা করেছে ১২ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মুনাফা হয়েছিল ৮ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এবার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ৬ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ সুপারিশ করেছে বিএসসি। আগামী শনিবার (২৪ নভেম্বর) চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের শহীদ মোহাম্মদ ফজলুর রহমান মুন্সি অডিটরিয়ামে এই সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বিএসসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ, সচিব খালেদ মাহমুদ, উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আতাউর রহমান, মোহাম্মদ আহসান-উল-করিম, লে. কমান্ডার এম আসিব রায়হান, মুহাম্মদ আবদুল জব্বার, আবুল কাশেম মাহমুদ, মোহাম্মদ আজমগীর, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান, ক্যাপ্টেন জামাল হোসেন তালুকদারসহ সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
- সংগৃহীত(দৈনিক আজাদী)